সাঁওতাল হুল বা বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ৩০ শে জুন, ১৮৫৫। ব্রিটিশ শাসন ও তাদের সাদা চামড়ার তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে সচেতন আদিবাসীরা (ভারতবাসী) সংগঠিত সশস্ত্র আঘাত এনেছিলেন। যদিও অ্যাকাডেমিক মূল্যায়নে এক অশিক্ষিত সংগ্রামশীল জনজাতি (Tribe বলা হয় তাঁদের, কেন তাঁরা জাতি (Nation), নৃগোষ্ঠী (Ethnic group) বলে বিবেচিত হন না জানা নেই আমার)। বলে দেওয়া ভালো এরাই ভারতবর্ষ নামক ভূখন্ডে বন জঙ্গল কেটে বৃহত্তর ছোটনাগপুর মালভূমিতে বাসস্থান ও কৃষির উপযোগী ভূমি তৈরি করেছিলেন। জঙ্গল পাহাড়ের পূর্বে সমতলেই ছিল তাদের বসবাস। আর্যরাসহ অন্যান্য গোষ্ঠী এই অঞ্চলে প্রবেশ করলে কখনো ছলে কখনো বলপ্রয়োগে জঙ্গলে ঠেলে দেয় তাদের।
কিন্তু মাত্র এক দুই হাজার বছর পিছনে গেলেই দেখা যাবে চরম স্বাধীনতাবাদী এই জাতি ১৮৫৫ এর হুলের বহু আগে আর্য জাতিকে হাজার হাজার বছর ধরে প্রতিরোধ করেছিলো জঙ্গলে থেকেই। সাদা চামড়াকে তারা "দিকু" বা বহিরাগত শয়তান নামে চিহ্নিত ও ঘৃণা করতো। ঋগবেদে আদিবাসীদের নিষাদ প্রজা, রাক্ষস, অসুর, কিরাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। চিন্তা চেতনায় এরা প্রকৃতিকে আরাধ্য মেনেই এক উন্নত সমাজ ও পরিবার পরিচালনা পদ্ধতির জন্ম দিয়েছিল এই ভূখন্ডে। জন্ম দিয়েছিল নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির।
১৮৫১ সালে ঐতিহাসিক সেরওয়েল এঁদের "এক স্বাধীন সুশৃঙ্খল জাতি" হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের বিদ্রোহই প্রথম শ্রমজীবী মানুষের মনে পরাধীনতার শিক্ষা ও স্বাধীনতার আকাঙ্খার বীজ রোপণ করেছিল বললে ভুল হয় না।
সাঁওতাল হুল ছিল ব্রিটিশ, তাঁদের পা চাটা বাঙালি, উত্তর-পশ্চিম থেকে আগত মহাজন, সুদখোর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে এক সার্বিক লড়াই। যার মূলে ছিল স্বাধীন সাঁওতাল রাষ্ট্রের দাবি এবং পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি তথা ভারতীয় বিশেষ আর্য সামন্তবাদী শোষণের বিরুদ্ধতা এবং তাকে বদলে ফেলার চেষ্টা। অর্থাৎ মুক্তি।
বিদ্রোহী রঘুনাথ এর সশস্ত্র সংগ্রামের পরে ১৭৭৪ সালে বীর বিদ্রোহী তিলকা মাঝির নেতৃত্বে সশস্ত্র হুল সংগঠিত হয়। সাথে সাথে চলতে থাকে অসংখ্য ভূমিজ বিদ্রোহ। পরে ১৮৫৫ সালে সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরৌ-ফুলো-ঝানো মুর্মুর নেতৃত্বে গ্রাম ভগনাডিহিতে চারশো গ্রামের প্রায় ১০ হাজার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং খুব দ্রুত তা গণবিদ্রোহের আকার নেয়।
কির্তা মাঝি, ভাদু মাঝি, সুন্নো মাঝির নেতৃত্বে বিভিন্ন কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট দের কাছে অত্যাচার অবসান ও জাতিগত স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে তাঁরা স্মারকলিপি দাখিল করেন। ইংরেজ শাসক এই দাবিপত্র পড়ে ভীত ও বিস্মিত হয়। কোনো ভারতীয় জাতি এমন স্বাধিকার সচেতন হতে পারে, ইংরেজদের কল্পনারও অতীত ছিল তা। যদিও আদিবাসী জনতার দাবি মানতে অস্বীকার করে ও অচিরেই একে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে।
ইতিমধ্যে কয়েকজন সাঁওতাল বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করায় প্রথমেই আন্দোলনকারীরা প্রকাশ্যে হত্যা করে কুখ্যাত দারোগা মহেশলাল দত্ত ও তার সিপাহী সঙ্গীদের। বিদ্রোহী আদিবাসীরা ঘোষণা করেন- "রাজা মহারাজাদের খতম করো, দিকুদের গঙ্গা পার করিয়া দাও, সমস্ত শাসনভার আমাদের চাই"। সম্ভবত এত স্পষ্ট রাজনীতির নলেজ তৎপূর্বে ভারতীয় সাদা 'শিক্ষিত' তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় ভদ্রদেরও ছিল না। আসলে তাঁরা (উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা) তখনও পর্যন্ত (একাংশ পরেও) ছিলেন ব্রিটিশদের দালাল।
হুল শুরু হলে আন্দোলনকারীরা ইংরেজ অফিসার বারোজের বিশাল সৈনবাহিনীকে তাঁরা হত্যা করে ও পাকুর,অম্বর পরগনার রাজবাড়ি লুঠ করে।অবিভক্ত বিহার বাংলার বিস্তির্ণ অঞ্চল বিদ্রোহীদের প্রায় মুক্তাঙ্গন হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য সাঁওতাল বিদ্রোহীরা গেরিলা যুদ্ধ রীতির সফল প্রয়োগ ঘটান এই অসম যুদ্ধে। এরপর বিদ্রোহীরা ডাক দেন কলকাতা অভিযানের। ঠিক যেন গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার মাওপন্থি লাইন! জানা যায়, মাত্র পনের দিনের মধ্যে অর্ধেক বাংলা ও বিহারে ইংরেজ শাসন বলে কিছু ছিল না-প্রায় মুক্তাঞ্চল। হতাশ ইংরেজ বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকে যাতে বিদ্রোহীরা খাবার না পায়। এক ব্রিটিশ অফিসারের কথায় – ‘আমরা বিদ্রোহ দমনের নামে গণহত্যা করিয়াছিলাম।’
২০০৮ সালে পুনরায় দেখা দিল আবার এক-হুল।এবারও বিদ্রোহীরা চাইলো খাদ্য, সেচ,স্বাস্থ্য, নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও স্থানীয় দিকু ও সরকারী পুলিশ-মিলিটারির অত্যাচার থেকে মুক্তি। তারা চাইলো মর্যাদা তথা প্রকৃত স্বাধীনতা। কারণ ভারতরাষ্ট্র আদিবাসীদের কোনোরকম স্বাধীনতা, অধিকার তাদের দিতে পারেনি।
১৮৫৫তে বিদ্রোহীদের মেরে ফেলেছিল ইংরেজ ও তাদের তাবেদার সামন্তচক্র। এবারও হত্যা করে গ্রেপ্তার করে আদিবাসী আন্দোলনকে পিষে দিল ভারতরাষ্ট্র। এখনও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে,চলছে ধর্মান্তকরণ কৌশলে হিন্দু বানিয়ে ফেলা হচ্ছে তাদের। সেই সঙ্গে চলছে তাদের অনাহার অর্ধাহার, অপুষ্টি, মৃত্যু। এবং প্রায়ই সন্ত্রাসবাদী দমনের নামে তাদের উপর অত্যাচার চলছে গণহত্যা চলছে। জল জঙ্গল জমি দখলের জন্য তাদের উৎখাত চলছে নানান অছিলায়। চলছে ভারতীয় সংবিধানকে সামনে রেখেই। সেবার আন্দোলনকারী নেতৃত্ব বীর সিধুর বিচার হয়েছিলো কিন্তু এখন স্বাধীন ভারতে আদিবাসীদের হত্যা করা হচ্ছে বিনা বিচারে। চলছে প্রায় প্রতিদিন।
প্রশ্ন হল, আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও যখন আদিবাসীরা শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন, অমর্যাদা থেকে মুক্ত হননি, তখন আদিবাসী হত্যাকারী রাষ্ট্র হুল দিবস (উৎসব) পালন করে চলেছে কীভাবে, কোন অধিকারে ?? সাঁওতাল বিদ্রোহকে উৎসব বা পরব বলার অধিকার সরকারকে কে দিয়েছে?
আজও হুল এক ধারাবাহিক গতিতে এগিয়ে চলেছে বলেই কী সরকার তাকে উৎসবে পরিণত করে প্রকৃত ইতিহাস থেকে জনগণকে দূরে রাখতে চায় ? আদিবাসীদের হিন্দু বানিয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে ভারতের তামাম আদিবাসী জনতাকে। তাহলেই হুল দিবসের যথার্থ অর্থ খুঁজে পাওয়া যাবে, আলো দেবে সমগ্র সমাজকে।
দেশের সমস্ত আদিবাসী বিদ্রোহ জিন্দাবাদ।
রঘুনাথ, তিলকা, সিধু-কানু-বিরসা জিন্দাবাদ।